
আজ ১৪ আগস্ট, বৃহস্পতিবার- বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন, খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২৩ সালের এই দিনে রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৩ বছর।
আল্লামা সাঈদী ছিলেন এমন এক আলেম, যিনি পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ-বিদেশে কোরআনের গভীর ভাষ্য তুলে ধরেছেন অনন্য ও হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে। তাফসিরের ময়দানে তার সুললিত কণ্ঠে ফুটে উঠত সাহিত্য, যুক্তি, আবেগ এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ। ফলে লাখো মানুষ তার মাহফিলে আগ্রহভরে অংশগ্রহণ করত।
চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ডে তার বাৎসরিক পাঁচ দিনের মাহফিলে দুইবার কাবা শরীফের ইমামও উপস্থিত ছিলেন। সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, কুমিল্লা, ঢাকা—দেশজুড়ে তার মাহফিল ছিল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
তিনি ছিলেন একাধিক বইয়ের লেখক। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৭৭টিরও বেশি। ‘তাফসিরে সাঈদী’, ‘সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালিন’, ‘কোরআনের দৃষ্টিতে মহাকাশ ও বিজ্ঞান’, ‘কাদিয়ানীরা কেন মুসলিম নয়’ প্রভৃতি গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। অনেক বই বিদেশি ভাষায় অনুবাদও হয়েছে।
পাশাপাশি তিনি বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশ সফর করে ইসলাম ও কোরআনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়েছেন।
১৯৪০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম।
ধর্মীয় শিক্ষার ভিত্তি লাভের পর, ১৯৬৪ সালে তিনি মাদরাসা শিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরবর্তী কয়েক বছর গবেষণায় নিয়োজিত থাকেন।১৯৬০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার চার ছেলে—রাফিক, শামীম, মাসুদ ও নাসিম—বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাগত ক্ষেত্রে যুক্ত ছিলেন বা আছেন।
১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং পরে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পরপর দু’বার পিরোজপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে তার প্রচেষ্টায় ইন্দুরকানী উপজেলাকে পুনর্গঠন করে জিয়ানগর উপজেলা গঠন করা হয়।
২০১০ সালের ২৯ জুন শহীদবাগে নিজ বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রথমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা হয়, পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেয়, যা আপিলে যাবজ্জীবন সাজায় রূপান্তরিত হয়। তিনি প্রায় ১৩ বছর কারাবন্দি ছিলেন।
তার পরিবার অভিযোগ করে, কারাবন্দি অবস্থায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি তিনি। হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ একাধিক শারীরিক জটিলতা থাকলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর দিন অ্যাম্বুলেন্সেও সিসিইউ সাপোর্ট ছিল না বলে দাবি তাদের।
মৃত্যুর পর লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। দেশের নানা স্থানে তার স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
তার বক্তৃতা, বই ও ভিডিও এখনো অনেকে শুনে থাকেন। তার আলোচনায় অনুপ্রাণিত হয়ে বহু মানুষ ইসলামের পথে ফিরে এসেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি যশোরে বসবাস করতেন। পরে নিরাপত্তাজনিত কারণে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। তাকে নিয়ে যুদ্ধপরবর্তী চার দশকে কোনো অভিযোগ প্রকাশ্যে আসেনি। সরকারি প্রকাশনা ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’-এর ১৮ খণ্ডেও তার নাম পাওয়া যায় না।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী বাংলাদেশের ধর্মীয় অঙ্গনে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাফসির, বক্তৃতা ও লেখালেখির মাধ্যমে তিনি দীর্ঘসময় সক্রিয় ছিলেন দেশ-বিদেশের ইসলামি চর্চায়। তার জীবনের নানা পর্যায় নিয়ে মতভেদ থাকলেও, একজন আলোচিত ও প্রভাবশালী আলেম হিসেবে তার উপস্থিতি অনেকের জীবন ও চিন্তায় রেখেছে স্থায়ী প্রভাব।